শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৩ পূর্বাহ্ন
বরিশাল নগরের রুপাতলীতে অবস্থিত শেখ রাসেল শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্রের বালক শাখায় দুই শিশুকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা এবং মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। একই সাথে কেন্দ্রের শিশুদের দিয়ে লাকড়ি, বড় বড় পাত্রে গরম খাবার আনা-নেয়াসহ ভাড়ি কাজ করানোর অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে শিকল দিয়ে বেধে রাখার একটি ভিডিও ও জ্বালানিতে ব্যবহৃত লাকড়ি বহনের ছবি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলেও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রটির দায়িত্বরত প্রকল্প উপ-পরিচালক বাসুদেব দেবনাথ।
তিনি জানান, এ ধরনের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবগত নন, তবে প্রমান পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঝালকাঠি আদালত দুজন ভবঘুরে শিশুকে শেখ রাসেল শিশু পূর্নবাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের হেফাজতে দেন।
জিসান ও হযরত নামের ওই দুই শিশু কেন্দ্রে আসার কয়েকদিন পরেই শিকল দিয়ে তাদের গাছের সাথে তালা মেরে রাখা হয়। যার একটি ভিডিও সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে বাহিরে চলে আসে। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে সোমবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) শেখ রাসেল শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্রে গিয়ে জানাগেছে, হযরত কেন্দ্রে থাকলেও সেখানে নেই জিসান।
হযরত জানান, জিসান কেন্দ্রের এক বড়ভাই মেহেদীর মারধরের ভয়ে পালিয়ে গেছে। আর ওই বড়ভাই-ই স্যারের নির্দেশে তাদের দুজনকে শিকল দিয়ে বেশ কয়েকদিন বেধে রেখেছিলো। আর স্যারের নির্দেশের কথা বড়ভাই মেহেদীই তাদের বলেছিলো। তবে স্যারের নাম জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
কেন্দ্রের অন্য নিবাসীদের অভিযোগ মেহেদী নামের ওই নিবাসী প্রকল্প উপ-পরিচালক, ফারুক নামের অপর এক কর্মকর্তারা কাছ থেকে আলাদাভাবে বিভিন্ন সুবিধা গ্রহন করে এবং প্রায়ই কেন্দ্রের বিভিন্ন শিশুদের মারধর ও বকাঝকা করে।
তবে মেহেদীর বক্তব্য অনুযায়ী, সে কাউকে মারধর করেন না, তবে তার দরজায় রাতের বেলা লাথি মারায় সে জিসান ও হজরতকে কেন্দ্রের খেলার মাঠের পাশেই শিকল দিয়ে বেধে রেখেছিলো। আর সেই শিকলটি কেন্দ্রের ভেতরেই তিনি পেয়েছেন। আর পুরো বিষয়টি কর্মকর্তাবৃন্দসহ কেন্দ্রের সবাই অবগত বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের সিনিয়র নিবাসীরা।
এদিকে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা দৈনিক মজুরী ভিত্তিক স্টাফরা জানান, তারা প্রয়োজন ছাড়া কোন শিশুকেই কোন কাজের কথা বলেন না। মাঝেমধ্যে সাহায্যের জন্য ছোট-খাটো কাজে তাদের সহয়তা করতে বলেন। তবে ভাত বা ডালের পাতিল আনানো, জ্বালানির কাঠ নেয়ার মতো ভাড়ি কাজ করান না।
যদিও কেন্দ্রের শিশু নিবাসীরা বলছেন, তারা বালক কেন্দ্র থেকে বালিকাদের কেন্দ্রে কিংবা বালিকা থেকে বালকদের কেন্দ্রে ভাত ও ডালের বড় বড় পাত্র, জ্বলানির লাকড়ি বহন করে থাকেন প্রায়ই। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোশাক ধোয়ার কাজও করেন।
আর কথা না শুনলে রোদে দাড় করিয়ে রাখাসহ বিভিন্নভাবে এসব শিশুদের শাস্তিও দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ুন কবির ও মামুন জানান, তারা প্রায়ই চলার পথে কেন্দ্রের শিশুদের ভাড়ি জিনিসপত্র বহন করতে দেখেন আবার অনেক সময় শিশুদের কাঁদতেও দেখেন। আবার আগে যেমন এসব শিশুদের মুখ থেকেই রোষ্ট-পোলাউসহ ভালো খাবার দেয়ার গল্প শোনা যেতো, এখন আর তা যায়না।
এদিকে বালিকা কেন্দ্রে এরকম সমস্যা না থাকলেও তারা মাটি কাটানো, ঘর মোছাসহ নানান কাজ করছেন। তবে এগুলোতে তেমন কোন কষ্ট না থাকায় তাদের অভিযোগও নেই।
সোমবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে শেখ রাসেল শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্র বালক ও বালিকায় গিয়ে দেখা গেছে, ছেলেদের থাকার ঘরগুলো খুবই জ্বরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বালিকা কেন্দ্রে প্রশিক্ষন কক্ষ ও বঙ্গবন্ধু কর্ণার তালাবদ্ধ রয়েছে। সংবাদকর্মীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কর্ণার খোলা হলে ব্যবহারের অভাবে সেটির ফ্লোরে যে ময়লা (নোনার ফ্যানা) জমে গেছে তা দৃশ্যমান হয়। এছাড়াও বালক কেন্দ্রে একটি কম্পিউটার থাকলেও সেটি রাখা হয়েছে শিক্ষকদের কক্ষে, ফলে এর সুবিধা পাচ্ছেনা শিশু শিক্ষার্থীরা।
সার্বিক বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের বরিশাল জেলার উপ-পরিচালক আল মামুন জানান, শিকল দিয়ে বেধে রাখার বিষয়টি জানার পরপরই একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। প্রতিবেদন পেলে প্রকল্প পরিচালকের কাছে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে। এছাড়া শিশু সুরক্ষা আইনে শিশু শ্রম একটি আইন পরিপন্থী বিষয়। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।
উল্লেখ্য সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত প্রকল্প অনুসারে ২০১২ সালে রুপাতলী মাওলানা ভাসানী সড়কে স্থপান করা হয় শেখ রাসেল শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্রের বালক শাখা। তার ঠিক দুই বছর পরে ২০১৪ সালে স্থাপন করা হয় ওই কেন্দ্রের বালিকা শাখা। উভয় কেন্দ্রে ২০০ নিবাসীর জন্য অনুমোদিত থাকলেও বর্তমানে দেড়শতাধিক নিবাসী রয়েছেন।